ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কালো ছায়া

ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কালো ছায়া: ভবিষ্যৎ কী?

Spread the love

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আমাদের দেশের খেলাধুলায় রাজনীতির ছায়া কতটা গভীর? মাঠের সবুজ গালিচা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুম পর্যন্ত, সবখানেই যেন রাজনীতির অদৃশ্য প্রভাব। এই প্রভাব কখনো আশীর্বাদ হয়ে আসে, আবার কখনো অভিশাপের মতো গ্রাস করে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনকে। কিন্তু কেন এমনটা হয়? আর এর প্রভাবই বা কতটুকু? চলুন, আজ ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কালো ছায়া র এই জটিল বিষয়টি নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি।

ক্রীড়াঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব: একটি দ্বিমুখী তলোয়ার

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ধারা চলে আসছে। তবে এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। যেমন, যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তখন খেলাধুলার উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসে। নতুন স্টেডিয়াম তৈরি হয়, প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ে, এমনকি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের সুযোগও মেলে। কিন্তু যখন এর উল্টোটা হয়, তখন যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যই বড় হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে সত্যিকারের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় না, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ক্ষতিকর।

ইতিবাচক দিক: যখন রাজনীতি বন্ধু হয়

আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন বা ক্লাবের দায়িত্বে থাকেন। এর ফলে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে খেলাধুলার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোনো ফুটবল বা ক্রিকেট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন, তখন সেই ক্লাবের স্পন্সরশিপ পেতে সুবিধা হয়, ভালো খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করা সহজ হয়। এমনকি সরকারি অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক হয়। এতে করে খেলাধধুলায় সামগ্রিক একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

image 53

নেতিবাচক দিক: যখন রাজনীতি শত্রু হয়

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। রাজনৈতিক প্রভাব যখন নেতিবাচক দিকে যায়, তখন তা ক্রীড়াঙ্গনকে পঙ্গু করে দেয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় বা আনুগত্য বড় হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে ভালো খেলোয়াড় বা কোচরা সুযোগ পান না, বরং যারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তারাই সুবিধা পান।

স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি: এক অদৃশ্য ব্যধি

আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় দেখা যায়, অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। খেলোয়াড় বাছাই থেকে শুরু করে টুর্নামেন্ট আয়োজন পর্যন্ত সবখানেই প্রভাব খাটানো হয়। এতে করে সত্যিকারের প্রতিভাবানরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং অনেক সময় খেলাধুলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এই সমস্যাগুলো এতটাই প্রকট যে, অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় দেশের বাইরে গিয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন।

দল নির্বাচন ও পারফরম্যান্সে প্রভাব

দল নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় দেখা যায়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়। এর ফলে দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ম্যাচের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেন, তাহলে হয়তো দেখতে পাবেন, কিছু খেলোয়াড় যারা নিয়মিত ভালো পারফর্ম করছেন না, তারাও দলে সুযোগ পাচ্ছেন। এর পেছনের কারণ অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব হতে পারে।

অবকাঠামো ও উন্নয়নের অভাব

রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে অনেক সময় ক্রীড়া অবকাঠামো উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি হয়। যখন একটি নির্দিষ্ট দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের পছন্দের জায়গায় উন্নয়ন হয়, আর বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে সেই প্রকল্পগুলো থমকে যায়। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ক্রীড়া অবকাঠামো দুর্বল থাকে।

সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ: একটি বিশ্লেষণ

সাম্প্রতিক সময়েও আমরা ক্রীড়াঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাবের অনেক উদাহরণ দেখেছি। বিশেষ করে ক্রিকেট এবং ফুটবলে এই প্রভাব বেশ স্পষ্ট।

ক্রিকেট বোর্ডের রাজনীতি

বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বরাবরই রাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বোর্ডের শীর্ষ পদগুলোতে প্রায়শই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা থাকেন। এর ফলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কখনো কখনো দেখা যায়, কোচের নিয়োগ থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের চুক্তি পর্যন্ত সব কিছুতেই এই প্রভাব কাজ করে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। এর পেছনে যেমন খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রম আছে, তেমনি বোর্ডের সঠিক সিদ্ধান্তও গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট ম্যাচের রান ভবিষ্যদ্বাণী করার সময়ও অনেক সময় বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রভাব বিবেচনা করা হয়।

ফুটবল: হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার

এক সময় বাংলাদেশের ফুটবল বেশ শক্তিশালী ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এর জৌলুস কমেছে। এর একটি বড় কারণ হিসেবে রাজনৈতিক প্রভাবকে দায়ী করা হয়। ফুটবল ফেডারেশনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রায়শই নানা ধরনের রাজনৈতিক কোন্দল দেখা যায়। এর ফলে মাঠের পারফরম্যান্সেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ক্লাবগুলোর মধ্যেও রাজনৈতিক প্রভাব দেখা যায়, যা খেলোয়াড়দের দলবদল এবং বেতন-ভাতায় প্রভাব ফেলে। ফুটবলে ডিফেন্সিভ ও অফেন্সিভ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দলগুলো কেন পিছিয়ে পড়ছে।

ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতির কালো ছায়া
খেলার ধরণইতিবাচক প্রভাবের উদাহরণনেতিবাচক প্রভাবের উদাহরণ
ক্রিকেটবড় টুর্নামেন্ট আয়োজন, স্পন্সরশিপবোর্ড রাজনীতি, দল নির্বাচনে প্রভাব
ফুটবলনতুন একাডেমি স্থাপনফেডারেশন কোন্দল, আর্থিক দুর্নীতি
হকিসরকারি অনুদানঅযোগ্য নেতৃত্ব
অন্যান্য খেলাসীমিত অবকাঠামো উন্নয়নকম মনোযোগ, বাজেট স্বল্পতা

সমাধান কি?

ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে এটি অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

পেশাদারিত্ব ও স্বচ্ছতা

ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোকে আরও পেশাদার ও স্বচ্ছ হতে হবে। দল নির্বাচন থেকে শুরু করে আর্থিক ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সব কিছুতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য স্বাধীন অডিট এবং মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের পজেশন এবং পাস অ্যাকুরেসি এর মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে দল নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।

তৃণমূল থেকে উন্নয়ন

শুধুমাত্র শীর্ষ পর্যায়ে নয়, তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলাধুলার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে খেলাধুলার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরেও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসার সুযোগ পাবেন।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা

ক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে কঠোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা এই ধরনের কাজে জড়িত, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়।

আপনার ভূমিকা

আপনি কি মনে করেন, এই বিষয়গুলো পরিবর্তন করা সম্ভব? আপনার মতামত আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আপনার মতো সচেতন পাঠকই পারেন এই আলোচনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করার জন্য কাজ করি। আপনারাও এই বিষয়ে আপনাদের মতামত জানাতে পারেন মন্তব্য বক্সে।


Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *